অশিক্ষিত বাবার একমাত্র সন্তান কালুমিয়া। দু'বেলা দু'মুঠো আহার যোগানের জন্য অসিমিয়াকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। তার বয়স হয়েছে এখন একটুতেই হাঁপিয়ে উঠেন। নিজেকে বারবার ধিক্কার দেন পড়ালেখা না করার জন্য। ধিক্কার দিয়ে কি আর হবে? অতীতকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। যতই কষ্ট হোক পরিশ্রম করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। মাঝে মাঝে উপোসও দিতে হয়। প্রতিদিন তো আর কাজ মেলেনা। তার বাবা-মা কতই না চেষ্টা করেছে অসিমিয়াকে শিক্ষিত করার জন্য। স্কুল পালানো ছেলে শিক্ষা লাভ করবে এটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। অসিমিয়াকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা পর্যন্ত হয়েছিলো। কোনটাই কাজে আসেনি। পরিনাম তাই হয়েছে যা এখন সে নিজে ভোগ করছে। অসিমিয়ার একমাত্র সন্তান কালুমিয়া। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কালুমিয়াকে হাফেজ বানাবেই। কালুমিয়া পড়ালেখায় তেমন একটা ভালো না। নাজেরা পড়তে পড়তে তার বয়স হয়েছে চৌদ্দ বছর। যে বয়সে হাফেজ হয়ে তারাবি পড়ে প্রচুর টাকা ইনকাম করা যায় সেই বয়সেও কালুমিয়া পড়ছে। হুজুররা তার ব্যাপারে আসা ছেড়ে দিলেন। অসিমিয়াকে ডেকে বললেন, আপনার ছেলেকে দিয়ে আর কিছুই করা সম্ভব হবে না। তাকে যা পাড়ানো হয় তার সবটুকু সে ভুলে যায়। তারপরও অসিমিয়া হাল ছাড়লেন না। যত বছরই লাগুক না কেন ছেলেকে হাফেজ বানাবেই। কালুমিয়া চেষ্টা করে যেতে থাকেন। চেষ্টায় যখন ব্যর্থ, কালুমিয়া সিদ্ধান্ত নিলো সে আর পড়ালেখা করবে না। অসিমিয়াকে পাগড়ি পরে এসে কালুমিয়া বললো, বাবা আমি হাফেজ হয়ে এসেছি। অসিমিয়ার আনন্দের শেষ নাই। খুশিতে অসিমিয়া খতমে গাউছিয়া পড়ালেন। কালুমিয়া পড়ালেখায় এগিয়ে না গেলেও গেয়ারবি শরিফ ভালোভাবে মুখস্ত রাখতে পেরেছিলো। মাইকে টেনে টেনে কালুমিয়া গেয়ারবি শরিফ পড়লেন। অসিমিয়ার মন প্রশান্তিতে ভরে গেলো। সেদিন এলাকার মিসকিনদের খাওয়ানো হয়। কালুমিয়ার কয়েকটি সুরা যে মুখস্ত নেই তা নয়। কন্ঠের মধুর সুরের কারণে নিজেকে চালিয়ে নিতে থাকে। দাওয়াতও আসে। আয় মোটামুটি ভালোই হতে থাকে। কন্ঠের জোর ও বুদ্ধিমত্তায় কালুমিয়া এলাকায় পপুলার ব্যাক্তিতে পরিণত হয়ে গেলেন। পাগড়ি ও লম্বা জুব্বা পরে আতর মেখে স্মার্টলি চলাচল করেন। কিছুদিনের মধ্যে কালুমিয়া হাফেজ কালুমিয়ায় পরিচিতি পেলেন। দাওয়াতের টাকা দিয়ে মোটামুটি দিনকাল ভালো যাচ্ছে।
কালুমিয়া ধর্ম কর্মে পাক্কা মুসল্লী বনে গেলেন। পাগড়ি সহজে খোলে না। হাতে তসবি । সবাই তাকে শ্রদ্ধা সম্মানের চোখে দেখে। কালুমিয়া মস্ত বড় আবেদ হিসেবে এলাকাময় প্রসিদ্ধি পেলেন। দোয়ার জন্য অনেকেই কালুমিয়ার কাছে আসতে থাকে। কালুমিয়া দোয়া করে বিনিময়ে হাদিয়া মিলে। খাওয়া-দাওয়া মন্দ নয়। দাওয়াত তো প্রতিদিন আছেই। তাকে সবাই দেবতার মতো সম্মান করে। শ্রদ্ধা সম্মানের দিক দিয়ে কালুমিয়া এলাকায় প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বনে গেলো। পেশাজীবী শ্রমজীবী কালুমিয়াকে কে শ্রদ্ধা সম্মানের চোখে দেখে না?পরীক্ষায় পাশের জন্য দোয়া নিতে আসে ছাত্ররা। কালু মুনাজাত ধরে। লম্বা মোনাজাতের মধ্য দিয়ে খোদার কাছে কান্নাকাটি করে ছাত্রদের পাশের জন্য ।মনে হা হুতাশ থাকলেও নিজের ফেল করার জন্য ,অন্যর পাশের জন্য নির্দ্বিধায় দোয়া করে যায়। দাওয়াতের জন্য কালুমিয়া এখন তেমন একটা সময় পায়না। দিনে দু'চারটা পাঁচটা পর্যন্ত দাওয়াত আসে। কোরআন খতম তো আছেই। মসজিদের খতিব হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। কসাসুল আম্বিয়া ও পৌরাণিক কিছু বইপত্র তার সংগ্রহে ছিলো। কোনমতে সে রিডিং পড়ার আয়ত্তটা করে নিয়েছিলো। রাতদিন সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। খুতবা দেওয়ার সময় সবার চোখে পানি ছলছল করে। ওয়াজ মাহফিলে কালুমিয়া সভাপতি। বলতে গেলে কালো মিয়ার কথায় এলাকার সবাই উঠবস করে। কালুমিয়ার প্রসিদ্ধি জেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। খুবই মুত্তাকী ধর্মভীরু আল্লাহ ভক্ত লোক। তসবি হাতে থাকে। কিছুক্ষণের জন্যও তসবি তাহলীল বাদ যায় না। কালুমিয়া কি পড়ে সেটা বিধাতাই ভালো জানে । সবার ধারণা কালুমিয়া নিজেকে জিকির আজকারের মধ্য দিয়ে নিমজ্জিত রাখে। ইদানিং সে তাবিজ কবজ , পানি পড়া দিয়ে ভক্তদের রোগ নিরাময়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার জন্য একটি হুজরা নির্মাণ করা হয়। নিত্যনতুন ভক্তবৃন্দ আসতে থাকে। আসার সময় তারা সামর্থ্যানুযায়ী নজরানা নিয়ে আসে। কেউ মুরগি মাছ টাকা আরো কত কিছু।
চন্ডীগ্রামে কালুমিয়ার বসবাস। গ্রামের মাঝখানে বিশাল একটি বিল । কথিত আছে বিলের মাঝখানে রাত বিরাতে সবাই ভয় পায় । জিনের আসর ছিলো বলে সবার ধারণা। কেউ রাতের বেলায় পারোত পক্ষে সেই বিল দিয়ে যাতায়াত করে না। যদিও উপজেলার রাস্তাটি বিলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এই বিলে অনেকে পাগল হয়েছে কিংবা মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে। লেংটা ফকির নামে একটি ফকির ছিলো সেই ফকিরসহ অনেকে এই চন্ডীবিলের মাঝে ফকিরত্ব পেয়েছে। এলাকাবাসীর ধারণা বিলে দুষ্ট জিনের বসবাস রয়েছে। একদিন কালুমিয়ার তরফ থেকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় আগামীকাল চন্ডীবিলের মাঠে বিকাল তিনটায় জনসভা হবে। সেখানে আরেক বড় পিরকে আহ্বান করা হয়। পিরের নাম ছিলো জুব্বা ফকির। জুব্বা ফকির নাম ডাক করা আউলিয়া। সে জেলা শহরের জুম্মা মাজারের খাদেন। শত শত লোক জমায়েত হলো। সভাপতিত্ব করছেন কালুমিয়া। এখন আর কালুমিয়া নাই মৌলভি কালুমিয়া। মৌলভি কালুর সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জুব্বা হুজুর। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়। জুব্বা হুজুর আউলিয়াদের কারামত সম্পর্কে বর্ণনা করলেন। জুব্বা হুজুর এক পর্যায়ে মৌলভি কালুমিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কালুমিয়া কত বড় মাপের আলেম এবং আল্লাহ ভক্ত পির সেটা একমাত্র জুব্বা হুজুরই জানেন। লোকরা ভাবলো সত্যিই তো,কালুমিয়া কখনো মিথ্যা বলে না। তার কাছে যেই দোয়ার জন্য যায় সেই দোয়াই তো ফলে যায়। সবার শেষে মৌলভি কালুমিয়ার বক্তব্য দেয়ার পালা। কালু বক্তব্যের শুরুতে জুব্বা হুজুরের অনেক তারিফ করলেন । জুম্মা মাজারের এই খাদেম সম্পর্কে অনেক কারামত তুলে ধরলেন। সর্বশেষ কালুমিয়া বললেন, আপনাদেরকে আমি এখানে ডেকেছি গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলার জন্য। গত রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখেছি চণ্ডীবিলের ফুলগাছ তলায় বিশাল এক বড় পিরের কবর রয়েছে। সেই পিরের বেয়াদবি করাতে রাত বিরাতে সবাই ভয় পায় । তার ভক্তরা এই পিরকে সম্মান না দেয়ায় ভয় দেখায়। পির সাহেব আমাকে স্বপ্নযোগে বললেন যদি এলাকাবাসী বিপদ থেকে বাঁচতে চায় তাহলে অতিসত্বর তুমি গিয়ে আমাকে উদ্ধার করো। এখানে একটি মাজার গড়ে তোলো। তোমার হুজরাটা মাজারের পাশে নিয়ে এসো। এলাকাবাসী ভাবলেন যে কারো স্বপ্ন নয়। মৌলভি কালুমিয়ার স্বপ্ন ; মিথ্যা হতেই পারে না। তাছাড়া এই বিলে তো সবাই ভয় পায় , ঘটনা অবশ্যই সত্যি। সে বলে এখন কি করা যায় মতামত দেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানে একটি মাজার গড়ে তুলবো। হুজুরের আত্মা যাতে আমাদের দিকে আর রাগান্বিত না হয়। সবাই সমস্বরে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন। কালু সবাইকে সাধুবাদ জানিয়ে মাজার গঠনের জন্য কালেকশন করতে উদ্যত হলেন। এলাকায় বিভিন্ন পেশাজীবীর বসবাস থাকলেও জেলের সংখ্যা ছিলো বেশি। তারা সাগরে ট্রলার বেয়ে প্রচুর মাছ পেতো। লক্ষ লক্ষ টাকা ইনকাম করতো। ওলা মাঝির ছিলো দশটি বোট। সে বললো মাজারের সব টাকা আমি দিতে চাই। ওলা সবার সামনে দুই লক্ষ টাকা দিলেন। সত্তার মাঝি ১ লক্ষ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিলেন। উপস্থিত মজলিসেই প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা উঠলো। সিদ্ধান্ত দিলেন তাঁরা মাজারের ছবি এঁকে আগামীকালেই মাজারের কাজ শুরু করবে।
মাজার হয়ে গেল। মাজারকে সাজানো হলো বিভিন্ন ফুল দিয়ে। মাজার উদ্বোধনের দিন জুব্বা হুজুরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। জুব্বা হুজুর পুরানো খেলোয়াড় , মাজারে কিভাবে টাকা আদায় করতে হয় তার ভালই জানা আছে।কালুমিয়াকে সেসব বিষয়েই অনেক পরামর্শ দিলেন। শুক্রবার জুমার নামাজের পর মাজার উদ্বোধন হয়। প্রথম দিনেই অনেক দূর দূরান্ত থেকে লোকসমাগম হয়। মাজার উন্নয়নের নামে মাজার উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়। প্রধান হলেন মৌলভি কালুমিয়া। সিদ্ধান্ত হলো জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থানে প্রায় এক হাজারটির মতো দানবাক্স বসানো হবে। সদ্য গড়ে ওঠা বিল্লা বাবার মাজারের জন্য। প্রথম দিনে অনেক টাকা উঠে। সব টাকা কালুর হাতে তুলে দেয়া হয়। বারো মাঘ ওরশের দিন নির্ধারণ করা হয়। ওরশের সময় সারা এলাকাকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১২ মাঘ লোক সমাগম হয় মাজারে নাচ ,গান তবলার সুরে সুরে বিল্লা বাবা বিল্লা বাবা বলে গান হয়। অনেকে মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য আসে। কারো সন্তান হয় না, ছেলে অবাধ্য ,পড়ালেখায় অমনোযোগী। সেদিন ঝড় বৃষ্টি হচ্ছেলো। নিঃসন্তান আকলিমা শুনেছিলো এ মাজারে গিয়ে কেউ নাকি খালি হাতে ফিরে আসে না। অবশ্যই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। মাজারের খোঁজ নিয়ে আকলিমা আসে। তখন মৌলভি কালু ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আকলিমা ছিলো খুবই সুন্দরী ফর্সা সুন্দর গঠনের। বিয়া হয়েছিল প্রায় ১৫ বছর কিন্তু একটি সন্তানের মুখ দেখেনি। অনুমতি নিয়ে মৌলভি কালুর খাস কামরায় প্রবেশ করে। মৌলভি কালু আকলিমাকে দেখে শিহরিত হয়ে উঠে। তাকে বোরকা খুলে ফেলতে বলা হয়। অনেকক্ষণ ঝাড় ফুক করলেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। একপর্যায়ে কালু নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে না পারে আকলিমাকে যুগে যুগে নারী পুরুষ একত্রে নির্জনে যেই দোয়া করে সেই দোয়াই করে দিলেন। ভাগ্যের জোরে আকলিমা সন্তান সম্ভাবা হয়ে গেলেন। দলে দলে নিঃসন্তান দম্পতিরা বিল্লা বাবার মাজারে আসে। মাজারের খাদেম পির মৌলভি কালুমিয়ার আশীর্বাদে সন্তান সম্ভবা হয়ে ফিরে যায়। এরকম শত শত সন্তানের জন্ম হয়েছে বিল্লা বাবার মাজারে এসে। পির মাওলানা কালু বাবার আশীর্বাদে।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
"জসিম উদ্দিন মনছুরি"
বাঁশখালীজনপদ২৪.কম'রঅনলাইনে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। যদি কপি করতে হয় তাহলে অনুমতি নিতে হবে অথবা কন্টেন্টের নিচে ক্রেডিট দিয়ে দিতে হবে।বাঁশখালীজনপদ২৪.কম' বাঁশখালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সম্পদ-সম্ভার, প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও স্থাপত্যশিল্প নিয়ে শেকড় থেকে শিকড়ের অনুসন্ধানে সবসময় সচেতন। বাঁশখালীকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। তাই, আমাদের সাথে থাকুন। সব খবর সবসময় সবার আগে পেতে ফেইসবুক পেইজ-এ লাইক দিন।
banshkhalijanaphad24@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন