জলকদর খাল দ্বারা বিভক্ত বাঁশখালীর পশ্চিমে রয়েছে খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গন্ডামারা ও ছনুয়া ইউনিয়ন। যে এলাকাটি পশ্চিম বাঁশখালী নামে পরিচিত। এর আরো পশ্চিমে রয়েছে বিশাল সমুদ্র। কোথাও সবুজ ঘাসে ঘেরা অনাবাদি জমি, লবণ মাঠ আবার কোথাও সমুদ্রতীরের সারি সারি ঝাউ বাগানের বিশালতায় পরিবেষ্টিত বাঁশখালীর পশ্চিম পাশটা।
অনেকের মতে বাঁশখালী জনপদের জন্য জলকদর খালটি স্রষ্টার একটি আর্শ্বীবাদও বটে। কেননা জলকদর খালের সঙ্গে যুক্ত বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের আটটি পাহাড়ি ছড়ার প্রবাহিত পানি দ্রুত খাল দিয়ে নামতে না পারায় অল্প বৃষ্টিতেই দেখা দেয় বন্যা। কারণ, অধিকাংশ স্লুইচ গেইটগুলো নানাভাবে দখল হয়ে আছে কিংবা বন্ধ থাকে। জলকদর খালটি শঙ্খ নদী হয়ে খানখানাবাদের অভ্যন্তরে বাহারছড়া, কাথারিয়া, সরল, গন্ডামারা, শীলকূপ, ছনুয়া, শেখেরখীল মধ্যবর্তী স্থান হয়ে আবারও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে। বাঁশখালীর ৮টি পাহাড়ি ছড়া- পুঁইছড়ির ছড়া, নাপোড়া ছড়া, চাম্বলের ছড়া, শীলকূপের বামের-ডানের ছড়া, জলদী ছড়া, পাইরাংয়ের ছড়া, কালীপুরের ছড়া ও সাধনপুরের ছড়া হয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু পানিগুলো নানা বাঁধার কারণে যথাযথভাবে জলকদর খালে পৌঁছাতে পারে না। যার দরুণ বর্ষায় অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে সাধারণ কৃষকদের ফসলি জমি তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় কৃষকসহ সাধারণ জনগণ।
এই জলকদর খালই অতীতে বাঁশখালীর জন মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো। বাঁশখালী থেকে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে কাউকে চট্টগ্রাম যেতে হলে নিশি যাপন করে অপেক্ষা করতে হতো বাংলা বাজার ঘাট থেকে শুরু করে চৌধুরী ঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে। জোয়ার ভাটার সময় নির্ধারন করে গভীর রাত থেকে কাক ডাকা ভোর পর্যন্ত কোলাহল মুখর থাকতো জলকদর খালের বাংলা বাজার, সরল, বশির উল্লাহ মিয়াজীর হাট ও চৌধুরী ঘাট। সে সময়ে এমনকি ধান, চাউল, লবণ, মাছ, শাক-সবজি ও মাতামহুরী থেকে দীর্ঘ চালায় চালায় বাঁশের বাণিজ্যে মুখর থাকতো জলকদরখাল। কিন্তু সেই ঐতিহ্যবাহী জলকদরখাল কালের বিবর্তনে হারিয়েছে তার রূপ, যৌবন। এখন জলকদরখালকে অনেকটা মৃত বল্লেই চলে। সময়ের বিবর্তনে যোগাযোগ ব্যবস্থা যতই উন্নত হোক না কেন নদী মাতৃক বাংলাদেশে বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নদীর ঐতিহ্য অস্বীকার করার জো নেই।
এ জলকদর খালকে ঘিরে বর্তমানে শেখেরখীল ফাঁড়িরমুখ, বাংলাবাজার ঘাট, জালিয়াখালী নতুনবাজার ঘাট ইকোনমিক জোনে পরিণত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে জেলেরা এসব ঘাটে ভীড় জমায়। জলকদর খালকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক মহাযজ্ঞ। কোটি কোটি টাকার জলযান এসব ঘাটে ভীড়ে। জেলেপল্লীর জীবন জীবীকার সাথে এ জলকদর জড়িত। ঐতিহ্যের এ জলকদর খালটি আজ বিলীনের পথে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জলকদরের দু'পাশের বেড়ীবাঁধ ভেঙে গিয়েছে। বাঁধের নিম্ন সীমানা জলের স্বাভাবিক সীমায় মিলিত হয়েছে। দখলে দূষণে নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পতিত হচ্ছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বঙ্গোপসাগরের মোহনা জলকদর খাল।জলকদর খালের উভয় পার্শ্বের দীর্ঘ ৩২ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। তাছাড়া নিত্যনৈমিত্য চলছে খালের দুই পাশে দখলের হিড়িক। দখলদারদের রাজত্বে বিলীনের পথে ঐতিহ্যবাহী এই খালটি। অপরদিকে জেলেদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন সাগর ও নদী কেন্দ্রিক হওয়ায় জলকদর খালের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার ফলে জেলে পল্লীর বাসিন্দারা কাঁদছে নীরবে, নিভৃতে। যেন দেখার কেউ নেই!
খালটি সংস্কারের জন্য সকলের পক্ষ থেকে দাবি জানানোর প্রেক্ষিতে প্রতি জেলায় একটি করে খাল সংস্কারে সরকার উদ্যোগ গ্রহন করেছে তাতে এ জলকদর খালটি রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা সুত্রে জানা গেলেও প্রতিনিয়ত খালটি দখল হয়ে পড়ায় দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছে। বাঁশখালীর ৮টি পাহাড়ি ছড়া, পুঁইছড়ির ছড়া, নাপোড়া ছড়া, চাম্বলের ছড়া, শীলকূপের ছড়া, জলদী ছড়া, পাইরাংয়ের ছড়া, কালীপুরের ছড়া ও সাধনপুরের ছড়া হয়ে পাহাড়ি ঢলের পানিগুলো পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। সেই পানিগুলো নানাভাবে জলকদর খালে গিয়ে পৌঁছতে না পারলে সর্বত্র বন্যার সৃষ্টি হয়। বিগত দিনে এই জলকদর খালে পানি নিস্কাশন সহজ হলেও সম্প্রতি সময় গুলোতে দুই পাশে অসংখ্য অবৈধ দখলদার ও ভরাট হয়ে যাওয়াতে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা দূরহ হয়ে পড়ে। অপরদিকে খালটি সরু হয়ে যাওয়াতে পূর্বের মত ব্যবসায়ীরা নানাভাবে বোট অথবা সাম্পানের মাধ্যমে আগের মত মালামাল পরিবহন করতে পারে না।
সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশে বাঁশখালীর জলকদর খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসন। উচ্ছেদ অভিযানের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে সীমানা নির্ধারণ ও উদ্ধার কার্যক্রম খানখানাবাদ ঈশ্বর বাবুর হাট অংশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবেই শুরু করেছে। তবে প্রশাসন কতটুকু সফল হবে এ খাল উদ্ধারে তার অপেক্ষায় সচেতনমহল।
banshkhalijanaphad24@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন