ঈদে মেয়ের শ্বাশুড়বাড়ীর ছাগল প্রথা ও আমাদের সমাজ!
ঈদ আসে ঈদ যায় পরিবর্তন আসেনা আমাদের সমাজে। দিন দিন কমে যাচ্ছে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ। হারাতে বসেছি ঐতিহ্য। সমাজটা আজকাল ঐতিহ্য হারাতে বসেছে কেবল কিছু অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে। সমাজ হিতৌষীরা কতো চেয়েছিল ঘূণে ধরা সমাজকে পরিবর্তন করতে। কিন্তু অপসংস্কৃতির গন্ডি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছিনা। যৌতুক প্রথা সমাজের বৃহত্তম একটি কৃত্রিম সৃষ্ট অভিশাপ। যার যাঁতাকালে পিষ্ট হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার গুলো। ধনীর দুলালীরা বাবার বিত্ত সম্পদের স্রোতে পার পেলেও নির্ঘুম অশ্রু ঝড়ে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোতে। যৌতুকের বোঝাটা বহন করতে পারেনা পরিবার গুলো। উপযুক্ত মেয়েকে পাত্রস্থ করাতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্তরা।আমার কাছে মেয়ের বাবার বাড়ী ছেড়ে শ্বাশুর বাড়ী চলে যাওয়াকে পৃথিবীর সপ্তাচার্যের একটি মনে হয়। তবে সেটা পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মেই হয়। কতো আদুরে লালিত কন্যা, মায়ের চোখের মণি, বাবার কলিজার টুকরো, ভাইয়ের আদুরের টুকরো হাসি যখন শ্বাশুর বাড়ীতে চলে যায় সব মায়া মমতা ত্যাগ করে তখন বড্ড অবাক হই! অচেনা এক জগৎকে ধীরে ধীরে আপন করে নেয় মেয়েটি। কিন্তু তার স্বাধিনতা শ্বশুরবাড়ীতে কামলার মতো। মেয়েটির বেশীদিন টিকেনা শান্তিতে যমপুরী শ্বাশুড়বাড়ীতে। কারণ শ্বাশুরবাড়ীতে নানা বাহনা দিয়ে মেয়েকে বলে- তোমার বাবার বাড়ী থেকে এবছর ঈদে সেমাই চিনি পাঠালে কম দিতে বলিয়েন না, নতুবা আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবোনা! কোরবানীর ঈদ এলে বলে- গরু ত চাইনি! ছাগলটা একটু সাইজের হলে ভালো হয়! সমাজের কাছে যাতে বলতে পারি আমার ছেলের শ্বশুরবাড়ী থেকে দ্যাখো দ্যাখো কত বড় ছাগল পাঠাইছে! আজব, এসব বলতে অনেকের জিবে লজ্জাও বাঁধেনা। লজ্জা উঠেগেছে সমাজ থেকে। আত্মসম্মান চলে গেছে আমাদের মনুষ্যত্বে।
ঈদ আসে মধ্যবিত্ত বাবাদের জন্য অভিশাপ হয়ে! কোরবানীর ঈদে মেয়ের শ্বশুর বাড়ীতে গরু-ছাগল দেওয়ার যে একটা অদ্ভুত নিয়ম, তা আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিনা। কোরবানিটা সম্পূর্ণ ধর্মীয় একটা বিষয়। যার সামর্থ্য আছে সে দিবে, আর অন্যদিকে যার সামর্থ্য নাই সে দিবে না। এটাই মূলত সওয়াবের আশায় মহান মুনীবের রেজামন্দী হাসিলের একটা সহজ পথ। এইতো সমাজের দুস্থ, অসহায়, গরীবদের খাওয়ানোর সুন্দর একটা পন্থা। তো মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীর লোকজন কি ফকির মিসকিন! যে তাঁদের আস্ত গরু ছাগল দিতে হবে? নাকি মেয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই এইটাও বাধ্যতামূলক হয়ে যায় যে, ছেলের বাড়ির সব ধর্মীয় নিয়মকানুন পালনের দায়িত্ব মেয়ে পক্ষের? এমনিতেই লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিয়ে দেয়। এভাবেই চলছে অামাদের তথাকথিত সভ্যসমাজ। এসব দৃশ্য দেখে সভ্যতার সংজ্ঞাটাও ভুলে যাই।
এখানেই শেষ নয়। তারপর শুরু হয় সিজনাল যা যা আছে। ধরুন, ফলমূল থেকে শুরু করে সব সিজনে সিজনে পীঠাপুলি, রমজানে ইফতারি, ঈদে শ্বাশুরবাড়ীর সবার জন্য কাপড়, তারপর আবার কোরবানীর গরু, ছাগল। অতচ কোরবানীর উদ্দেশ্যটাই পাল্টে দেয় এসব নিয়মকানুন। একেকটি ঈদ মেয়ের মধ্যবিত্ত বাবাদের জন্য আসে অভিশাপ হয়ে, হিমালয়ের বরফগলা কষ্টের জল হয়ে। খুশির চাঁদটিই যেন তাদের কাছে শনির দশা, কালো রেখা। আজকাল ধর্মীয় নিয়মকানুনের মাঝে ঢুকে গেছে এই দেওয়া নেওয়ার প্রথা। বাকি সব বাদ যাবে কেন? বিয়ের পর মেয়ের বাপে দিবে, যাকাত ফিতরা সব মেয়ের বাপ থেকে নিয়ে দিবে, পারলে নামায দোয়া পড়ে দিবে ছেলে পক্ষের হয়ে মেয়েপক্ষ! তারপরও আমাদের সুশীল সমাজের কুশিলব গং কি করে বলে নারী স্বাধীনতার কথা? নারীরা তো সবচেয়ে বড় অবহেলিত। নারী নেতৃত্বের দেশে এসব প্রথা চরম হাস্যকর। এসব বিদঘুটে অন্ধকার কবে আলোর পথ দেখাবে? কবে সমাজ কলঙ্কমুক্ত হবে? কবে সমাজের পরিবর্তন আসবে? কবে সাম্যবাদের নীতি বাস্তবায়ন হবে? কবে দূর হবে এই বৈসম্যনীতি?
সম্মানিত উচ্চবিত্ত পরিবার! আপনারা এসবের পিছনে অনেকাংশেই দায়ী। কারণ আপনাদের সামর্থ্য আছে তাই সমাজে জন্ম নিলো যৌতুক প্রথা, কোরবানীর ছাগল দেওয়া প্রথা, ঈদে সবার জন্য কাপড় পাঠানো প্রথা। আপনারা শুরু করেছেন তো সমাজে সেটা প্রথা হয়েগেছে। আর এসব প্রথাগুলো অভিশাপে রুপ নিয়েছে সমাজে। এই জন্যে আপনাদের দায়ী করি। আসুন আমরা মহান হই, উদার হই। সমাজকে কলঙ্কমুক্ত করি। পরের দিকে আর না! ভাবুন জুলুম হচ্ছে আপনার এপাড়ের আবদার ওপাড়ের কাছে। আপনি ছেলের বাবা মানে এই নয় যে, আপনি সবকিছুতে মোড়ল। যদি তা ভাবেন তাহলে আপনি ক্ষুদ্র, হীনচেতা লোক, ফকির মিসকিনের একাংশ, অাত্মসম্মানের লেশমাত্র নাই। এসব দেওয়া নেওয়াকে আমি সম্মান ও মার্যাদা হানিকর মনে করি। আমিও (রানা) এই প্রথার শিকার হয়েছিলাম। আমাকেও নিতে হয়েছে তীব্র বাঁধা উপেক্ষা করে! ওপাড়ের উত্তর শুনে অবাক হয়েছি। তাদের যেন স্টাটাসে পঁচন ধরবে তাই হজম করতে হয়েছে। কেবল সমাজ! সমাজের কুপ্রথা। সামর্থ্য থাকুক বা না থাকুক এসব কিছুতেই মানবসমাজে গ্রহণযোগ্য না। আপনি বিবেক দিয়ে বিচার করুন এটা অন্যায় কিনা, যদি তাই মনে হয় তবে পরিহার করুন। কোরবানীর ঈদে গরু-ছাগলকে না বলুন, ঈদে পরিবারের সবার জন্য কাপড় দেওয়া নেওয়াকে না বলুন। এই অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে সমাজকে মুক্ত করতে আমাদের তরুণপ্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।
শিব্বির আহমদ রানা
লেখক- শিক্ষক ও সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন