advertisment

advertisment
বিজ্ঞাপন দিন

ব্রেকিং নিউজ

ভাঙনের খেলা আর দখল বাণিজ্যে বাঁশখালীর জলকদর খাল বিলীন হওয়ার পথে -বাঁশখালীজনপদ২৪.কম

দখল বাণিজ্য, বাঁধের ভাঙন রোধ করতে না পারলে অস্থিত্ব সংকটে পড়বে ঐতিহ্যের জলকদর খাল

 শেখেরখীল পয়েন্ট- বিশাল জলরাশির জলকদরের দু'পাড়ের বেঁড়ীবাধে ভাঙন।

শিব্বির আহমদ রানাঃ চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উপজেলা বাঁশখালী। উপজেলার এক পাশে পাহাড় অন্য পাশে বঙ্গোপসাগর, মাঝখানে সরল রেখার মত দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলে গেছে ঐতিহ্যবাহী জলকদর খাল।বাঁশখালীকে দুই খন্ডে বিভক্ত করেছে এই খাল৷ পশ্চিম পার্শ্বে পশ্চিম বাঁশখালী এবং পূর্বে পূর্ব বাঁশখালী৷ অনেক ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই খাল৷ শঙ্খ নদী থেকে শুরে হয়ে উজানঠিয়া খালে গিয়ে শেষ হয়েছে এই জলকদর খালটি ৷ এই খালটি আবার বাগদা চাষের জন্যও বিখ্যাত ৷ জলকদরের পাশ্ববর্তী জনপদের মানুষের জীবন জীবীকার উৎস এ খালটি।

১৫০ বর্গমাইলের এই উপজেলার ঐতিহ্যের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে জলকদর খাল। খানখানাবাদের উত্তর সীমান্তে ঈশ্বরবাবুর হাট পয়েন্ট ও রাতারকুল গ্রামের জেলেপাড়া ঘেঁষে জলকদর সাঙ্গু নদীতে মিলিত হয়েছে। মোহনাটি লোকালয়ে কুরিচোরা ঘাট নামে পরিচিত। এর পূর্বপাশে রাতাখোর্দ্দ গ্রাম ছিলো, যা শংখের ভাঙনে আজ বিলীন। তাছাড়াও মোহনার উত্তর পাশে শংখের ওপারে আনোয়ারার জুইদন্ডীর গ্রামের অবস্থান। উত্তরে কুঁরিচোরা ঘাট থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৩২ কি.মি দীর্ঘ এই জলকদর বাঁশখালীকে দু’ভাগে বিভক্ত করে গন্ডামারা থেকে একটি ধারা খাটখালী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। খাটখালী ঘাটের দক্ষিণ পাশে ছনুয়া ও উত্তরপাশে গন্ডামারার অবস্থান এবং মোহনার বিপরীত পাশে রয়েছে কুতুবদিয়া দ্বীপ। অন্যধারাটি গন্ডামারা থেকে পূর্বদক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে পেকুয়ার বারবাকিয়ার দিকে চলমান। 

জলকদর খাল দ্বারা বিভক্ত বাঁশখালীর পশ্চিমে রয়েছে খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গন্ডামারা ও ছনুয়া ইউনিয়ন। যে এলাকাটি পশ্চিম বাঁশখালী নামে পরিচিত। এর আরো পশ্চিমে রয়েছে বিশাল সমুদ্র। কোথাও সবুজ ঘাসে ঘেরা অনাবাদি জমি, লবণ মাঠ আবার কোথাও সমুদ্রতীরের সারি সারি ঝাউ বাগানের বিশালতায় পরিবেষ্টিত বাঁশখালীর পশ্চিম পাশটা। 

বাঁশখালী জনপদের জন্য জলকদর খালটি স্রষ্টার একটি আর্শ্বীবাদও বটে। কেননা জলকদর খালের সঙ্গে যুক্ত বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের আটটি পাহাড়ি ছড়ার প্রবাহিত পানি দ্রুত খাল দিয়ে নামতে না পারায় অল্প বৃষ্টিতেই দেখা দিচ্ছে বন্যা। কারণ, অধিকাংশ স্লুইচ গেইটগুলো নানাভাবে দখল হয়ে আছে কিংবা বন্ধ থাকে। জলকদর খালটি শঙ্খ নদী হয়ে খানখানাবাদের অভ্যন্তরে বাহারছড়া, কাথারিয়া, সরল, গন্ডামারা, শীলকূপ, ছনুয়া, শেখেরখীল মধ্যবর্তী স্থান হয়ে আবারও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে। বাঁশখালীর ৮টি পাহাড়ি ছড়া- পুঁইছড়ির ছড়া, নাপোড়া ছড়া, চাম্বলের ছড়া, শীলকূপের বামের-ডানের ছড়া, জলদী ছড়া, পাইরাংয়ের ছড়া, কালীপুরের ছড়া ও সাধনপুরের ছড়া হয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু পানিগুলো নানা বাঁধার কারণে যথাযথভাবে জলকদর খালে পৌঁছাতে পারে না। যার দরুণ বর্ষায় অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে সাধারণ কৃষকদের ফসলি জমি তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় কৃষকসহ সাধারণ জনগণ।

এই জলকদর খালই অতীতে বাঁশখালীর জন মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো। বাঁশখালী থেকে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে কাউকে চট্টগ্রাম যেতে হলে নিশি যাপন করে অপেক্ষা করতে হতো বাংলা বাজার ঘাট থেকে শুরু করে চৌধুরী ঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে। জোয়ার ভাটার সময় নির্ধারন করে গভীর রাত থেকে কাক ডাকা ভোর পর্যন্ত কোলাহল মুখর থাকতো জলকদর খালের বাংলা বাজার, সরল, বশির উল্লাহ মিয়াজীর হাট ও চৌধুরী ঘাট। সে সময়ে এমনকি ধান, চাউল, লবণ, মাছ, শাক-সবজি ও মাতামহুরী থেকে দীর্ঘ চালায় চালায় বাঁশের বাণিজ্যে মুখর থাকতো জলকদরখাল। কিন্তু সেই ঐতিহ্যবাহী জলকদরখাল কালের বিবর্তনে হারিয়েছে তার রূপ, যৌবন। এখন জলকদরখালকে অনেকটা মৃত বল্লেই চলে। সময়ের বিবর্তনে যোগাযোগ ব্যবস্থা যতই উন্নত হোক না কেন নদী মাতৃক বাংলাদেশে বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নদীর ঐতিহ্য অস্বীকার করার জো নেই। 

এ জলকদর খালকে ঘিরে বর্তমানে শেখেরখীল ফাঁড়িরমুখ, বাংলাবাজার ঘাট, জালিয়াখালী নতুনবাজার ঘাট ইকোনমিক জোনে পরিণত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে জেলেরা এসব ঘাটে ভীড় জমায়। জলকদর খালকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক মহাযজ্ঞ। কোটি কোটি টাকার জলযান এসব ঘাটে ভীড়ে। জেলেপল্লীর জীবন জীবীকার সাথে এ জলকদর জড়িত। ঐতিহ্যের এ জলকদর খালটি আজ বিলীনের পথে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জলকদরের দু'পাশের বেড়ীবাঁধ ভেঙে গিয়েছে। বাঁধের নিম্ন সীমানা জলের স্বাভাবিক সীমায় মিলিত হয়েছে। দখলে দূষণে নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পতিত হচ্ছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বঙ্গোপসাগরের মোহনা জলকদর খাল। জলকদর খালের উভয় পার্শ্বের দীর্ঘ ৩২ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। তাছাড়া।নিত্যনৈমিত্য চলছে খালের দুই পাশে দখলের হিড়িক। দখলদারদের রাজত্বে বিলীনের পথে ঐতিহ্যবাহী এই খালটি। অপরদিকে জেলেদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন সাগর ও নদী কেন্দ্রিক হওয়ায় জলকদর খালের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার ফলে জেলে পল্লীর বাসিন্দারা কাঁদছে নীরবে, নিভৃতে। যেন দেখার কেউ নেই!

স্থানীয়রা জানান, একসময় বাঁশখালীর ব্যবসায়ীরা নৌকা এবং সাম্পানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে বিনা বাধায় এই জলকদর খাল হয়ে সব ধরনের মালামাল নিয়ে আসতেন শঙ্খ নদী হয়ে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও জলকদর খালের অধিকাংশ এলাকা অবৈধ দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় আগের সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যবসায়ী এবং বাঁশখালীবাসী। জলকদের তীরে গড়ে উঠা জেলেপল্লী গুলো বর্ষায় আতংকে থাকে। বেড়ীবাঁধ ভেঙে কখন যে তলিয়ে যাবে তাদের স্বপ্নের বসতঘর।

ইকোনমিক জোন খ্যাত এ জলকদর খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে এ অঞ্চলের উৎপাদিত লবণ সরবরাহ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো ভোগান্তির মুখে পড়ছে। এছাড়া, পাহাড়ি ছড়াগুলোর ঢল দখলের কারণে অপ্রশস্ত খাল দিয়ে নিষ্কাশন হতে না পেরে বাঁশখালীতে দেখা দেয় বন্যার। ডুবে যায় নিম্নাঞ্চল। ক্ষতির বোঝাটি বারবার পুষে নেয় কৃষক ও সাধারণ জনতা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী প্রকাশন চাকমা ’বাঁশখালীজনপদ২৪.কম’ কে বলেন, 'ঐতিহ্যবাহী জলকদর খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য তালিকা করা হয়েছে। আর সরকার প্রতি জেলায় একটি করে ঐতিহ্যবাহী খাল সংস্কারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে বাঁশখালীর জলকদর খালটিও রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের একটি প্রকল্প নিশ্চিতে আছে। জলকদর খালের দু'পাড়ের ভাঙনের কাজ সংস্কার করা হবে। নদী রক্ষার কাজ সহ এসব বিষয় মিনিষ্ট্রিতে প্রক্রিয়াধীন।'

কবে নাগাদ জলকদরের ভাঙনরোধে বেঁড়ীবাধ নির্মান করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'টেইকসই কাজ করতে অনুমোদন হওয়া লাগে। বড় আকারের কাজ এ মুহূর্তে সম্ভব না। বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে অতীব জরুরী কাজগুলো দ্রতই সমাধান করা হবে। তবে, জলকদরের দুর্বল বাঁধের কাজের একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানান তিনি। আশা করছি জলকদর আগের অবস্থা ফিরে পাবে।'




বাঁশখালীজনপদ২৪.কম'অনলাইনে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র,  রেখাচিত্র,  ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। যদি কপি করতে হয় তাহলে অনুমতি নিতে হবে অথবা কন্টেন্টের নিচে ক্রেডিট দিয়ে দিতে হবে।

বাঁশখালীজনপদ২৪.কম' বাঁশখালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সম্পদ-সম্ভার, প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও স্থাপত্যশিল্প নিয়ে শেকড় থেকে শিকড়ের অনুসন্ধানে সবসময় সচেতন। বাঁশখালীকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। তাই, আমাদের সাথে থাকুন। সব খবর সবসময় সবার আগে পেতে ফেইসবুক পেইজ-এ লাইক দিন।

আপনার মেইল পাঠাতে:
banshkhalijanaphad24@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই